হাদী-উল ইসলামঃ হঠাৎ যদি পৃথিবী তার কক্ষপথে এক সেকেন্ডের জন্য থেমে যায় তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠে যে সুনামি তৈরি হবে তার ধাক্কা সামলানোর পৃথিবীর পক্ষে খুবই অসম্ভব। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবী হয়তো কক্ষপথের থেমে যায়নি, থেমে গিয়েছে অন্যভাবে! আর এই থেমে যাওয়ার সুনামি প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে মানুষের জীবন ও জীবিকায়। দেশে আনুমানিক ৭৫-৮০ হাজার কোটি টাকা বছরে ক্ষুদ্র ঋণ হিসেবে আমাদের অর্থনীতিতে প্রবাহিত হয়, যার সিংহভাগই যায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে। গ্রামীণ অর্থনীতির এই অক্সিজেন প্রবাহ যদি ধরে রাখা না যায়, তাহলে কৃষি উৎপাদন, দুগ্ধ, মৎস্য উৎপাদন, পল্লী কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র উদ্যোগ, প্রভৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে এবং সেটা হবে নেতিবাচক। খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থেই কৃষি উৎপাদন সহায়তার জন্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রবাহ দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন। দারিদ্র্য কমিয়ে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোতে আমাদের যে সাফল্য, করোনাভাইরাস সৃষ্ট দুর্যোগ সেই সাফল্য আমাদের পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মহীন থাকায় পারিবারিক সঞ্চয় অনেকেরই নিঃশেষের পথে। সামাজিক জীবনে আয় ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা খুবই বেশি। ধনীর আয় কমে গেলে, দরিদ্রের কর্মসংস্থানে তার প্রভাব পড়বে এটা খুবই স্বাভাবিক। বিভিন্ন পত্র পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, অসংখ্য গৃহকর্মী কর্মসংস্থান হারিয়েছে, ভিক্ষুকদের আয় কমেছে। যদিও এই সময়ে রিলিফ কার্যক্রম একটি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবুও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই জীবন জীবিকার জন্য অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসূচিসমূহ একদিকে যেমন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, অপরদিকে পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে আরো নতুন গ্রুপ অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা সেটা নিয়েও যথেষ্ট ভাবা দরকার। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ লক্ষ শিশু নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির বাইরে আছে। এমনটি কখনোই নয় যে, সরকার এটা করছে না। বরং নতুন স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তারা প্রচুর পরিশ্রম করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এই বিশাল সংখ্যক শিশু যদি টিকাদান কর্মসূচির বাইরে থেকে যায় তাহলে সেটা হবে আমাদের জন্য একটি বড় ধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকি। সরকারের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থাগুলো একটি কর্ম পরিকল্পনা কিংবা নতুন উদ্ভাবনীর মাধ্যমে এই শিশুগুলোকে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনতে পারে। টিকাদান কার্যক্রমে বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকের একটি সুনাম সারা পৃথিবী জুড়ে রয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীদের জন্য গর্ভকালীন পরিচর্যা সেবা, ও নিরাপদ প্রসব সেবা আরো বিস্তৃত করতে হবে। শিক্ষাখাতে আঘাতটি আরো বিস্তৃত। প্রায় তিন মাস হয়ে গেল, শিক্ষার্থীরা স্কুল বঞ্চিত। অন্যান্য ইনফরমাল এডুকেশন সেন্টারগুলোতেও শিক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী আরো কয়েক মাস হয়তো শিশুদের স্কুলে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে তাদের বঞ্চিত হওয়ার একটি ঝুঁকি ইতিমধ্যেই আবির্ভাব হয়েছে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এখানেও ভাবতে হবে, কি করে নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে এত বিশাল সংখ্যক শিশুদের মাঝে গুণগত শিক্ষা নিয়ে পৌঁছা যায়। সামাজিক ইস্যুগুলোকেও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। করোনায় সৃষ্ট "জীবনবদ্ধতা"র জন্য, পারিবারিক নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এসেছে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মানুষ যত দারিদ্র হয়, বাল্যবিবাহের হার তত বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য কমানোর জন্য "মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিদায় করা" উৎকৃষ্ট মানের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। তখন অবশ্যম্ভাবীভাবে যৌতুকের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। আরো ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, মানুষের কাছে যতটা না সঠিক তথ্য, তার চেয়ে বেশি ভুল তথ্য! যে যার যার মত বিশ্বাস করছে এবং সেই বিশ্বাসের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। হোক সেটা সমাজের জন্য ক্ষতিকর সেটা দেখার দরকার নেই। সমাজের স্বার্থে আমরা প্রচুর সঠিক তথ্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছিয়েছি। এখন আবার এই কাজগুলো শুরু করা দরকার। সমাজকে প্রকৃত তথ্য দিতে হবে। তা না হলে, অনেক অগ্রযাত্রা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। সরকারকেও বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে এনজিওগুলোকে আরো সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। বৃহৎ নেতৃত্বদানকারী বেসরকারি সংস্থাগুলোর এ সকল কাজে প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদেরকেও এসকল কাজে নেতৃত্বের জন্য দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। দেশের স্বার্থে, দেশের উন্নয়নে এবং জনগণের অগ্রযাত্রায় এনজিও গুলোর কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করতে হবে। দরকার সরকার ও দাতা সংস্থারগুলোর প্রসারিত সহযোগিতা।