গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। পাশাপাশি ন্যূনতম বিল ও সার্ভিস চার্জ বাড়ানোরও আবেদন জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গতকাল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) চলা ধারাবাহিক গণশুনানির তৃতীয় দিনে এ প্রস্তাব তুলে ধরেন আরইবি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন। তা পর্যালোচনা করে ইউনিটপ্রতি ৭ দশমিক ১৯ শতাংশ বা ৪৪ পয়সা বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি।
এদিকে শুনানিতে অংশ নিয়ে গ্রাহক ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধি এবং রাজনীতিকরা জানান, গ্রামে মানসম্মত বিদ্যুৎসেবা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। মাসিক বিল, মিটার সংযোগসহ প্রতি সেবার জন্য হয়রানির শিকার হন সাধারণ গ্রাহক। যেখানে বিদ্যুৎই থাকে না সেখানে মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নই আসে না। পল্লী অর্থনীতির বিকাশের জন্য মানসম্মত বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিতে প্রয়োজনে সরকারকে সরাসরি ভর্তুকি দিতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই গ্রহাক পর্যায়ে দাম বাড়ানো যাবে না।
তবে দাম বাড়ানোর পেছনে যুক্তি তুলে ধরে আরইবি চেয়ারম্যান বলেন- জনবল, অবকাঠামো, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ, অবচয় খরচ বেড়েছে। তা ছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নিট খুচরা সরবরাহ ব্যয় ইউনিট প্রতি ৬ টাকা ৭০ পয়সা। বিদ্যমান খুচরা ট্যারিফ ইউনিটপ্রতি ৬ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ প্রতিইউনিটেই ঘাটতি ৬৫ পয়সা। গত অর্থবছরে আরইবি ৮০০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। ৭৯টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মধ্যে মাত্র ১১টি আর্থিকভাবে সচ্ছল। অসচ্ছল সমিতিগুলো তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। ঋণ ও সুদের কিস্তি বকেয়া পড়েছে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি আবাসিকে ন্যূনতম বিল ৬৫ থেকে ২০ টাকা বাড়িয়ে ৮৫ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে আরইবি। এ ছাড়া সার্ভিস চার্জ ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ টাকা করার আবেদন জানানো হয়েছে। আবাসিকে সর্বনিম্ন এক দশমিক ৫৬ থেকে ১২ দশমকি ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। সর্বোচ্চ বৃদ্ধির প্রস্তাব এসেছে ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিট ব্যবহারকারী গ্রাহকদের। এই ধাপে বর্তমানে ইউনিটপ্রতি দাম ৫ টাকা ৬৩ পয়সা, আরইবির প্রস্তাব অবশ্য ৬ টাকা ৩৩ পয়সা। অর্থাৎ বর্তমান দাম থেকে ৭০ পয়সা বাড়াতে চায়। অন্যান্য শ্রেণির গ্রাহকদের ক্ষেত্রেও সার্ভিসচার্জ বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে।
আরইবির সারা দেশে গ্রাহক রয়েছে দুই কোটি এক লাখ। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই আবাসিক। তাদের প্রস্তাব বিবেচনা করে মূল্যায়ন কমিটি জানিয়েছে, অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে কম দামে পাইকারি বিদ্যুৎ কেনায় বছরে আরইবির প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার মতো সাশ্রয় হয়। এর পরও বিতরণ ব্যয় বাড়ায় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো উচিত। তাই কমিটি কমিশনের কাছে ইউনিটপ্রতি গড়ে ৪৪ পায়সা বৃদ্ধির সুপারিশ রেখেছে।
শুনানিতে অংশ নিয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, রাজধানী ও শহরের মানুষ ভালোমানের বিদ্যুৎসেবা পেলেও গ্রামের জনগণ তা থেকে বঞ্চিত। নিজের উদাহারণ টেনে তিনি বলেন- আমার বাসা সেগুনবাগিচায়, যেখানে লোশেডিং প্রায় হয় না। মাঝে মাঝে কুষ্টিয়া জেলা শহরে গেলেও সহনীয় লোডশেডিং চোখে পড়েছে। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুৎ কখন আসে সেটিই বলা মুশকিল। এমন অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব যৌক্তিক নয়।
তিনি আরও বলেন, আরইবির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুতের সংস্থান রাখতে হবে। বিশেষ করে রাতের বেলা তাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন বেশি। এ জন্য কমিশনের বিশেষ নির্দেশনার আবেদন জানান তিনি।
সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আরইবি নিম্নমানের মিটার ও ট্রান্সফরমার সরবরাহ করে বলে অভিযোগ। তা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া গ্রহাকদের মিটার যাচাই না করেই ভুতুড়ে বিলের অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে আরইবি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি সেবা না বাড়িয়ে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোই উচিত বলে মনে করেন এই বাম নেতা।
গণশুনানিতে সভাপতিত্ব করেন বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য রহমান মুরশেদ, মাহমুদউল হক ভূঁইয়া, আবদুল আজিজ খান ও মিজানুর রহমানসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা।